তানিন আফরিন,গাইবান্ধা থেকেঃ
আসন্ন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ-জাপা এবং
বিএনপি থেকে কে বা কারা এগিয়ে আছেন তা নিয়ে এখন গাইবান্ধায় চলছে নানান
জল্পনা কল্পনা সরগরম।
গাইবান্ধার রাজনীতি আওয়ামী
লীগ-জাপা আর বিএনপিকে ঘিরেই ঘুরপাক খেয়ে থাকে। অবশ্য এবার জামায়াতের ভিন্ন
রাজনৈতিক কৌশলে অনেকের মনেই নানা প্রশ্নের দেখা দিয়েছে। বড় তিন দলের দলীয়
কোন্দলের কারনে এখানে সুবিধা করতে পারেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী।
রাজনীতির
মাঠে শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ফুরফুরে
মেজাজে থাকলেও নেতাকর্মীদের মধ্যে পাওয়া, না পাওয়া থেকে ক্ষোভ-মতবিরোধ এবং
তীব্র অন্তর্কলহ রয়েছে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতাকর্মীরা
এখন নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এক পক্ষ আরেক
পক্ষের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও কাদা ছোড়াছুড়ির সঙ্গে মাঠ দখলের
লড়াইয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তবে একে দলীয় কোন্দল-বিভক্তি নয় বরং নেতৃত্বের
প্রতিযোগিতা হিসেবেই দেখছেন দলটির জেলা নেতৃবৃন্দ।
অন্যদিকে
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না সে বিষয়ে এখনও
সিদ্ধান্ত না নিলেও রাজপথের আন্দোলন জোরদারের মাধ্যমে দাবি আদায় করার
পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে দলটি। জেলায় দলটির সাংগঠনিক
কর্মকাণ্ড কেবল কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলো পালন করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়ে চলছে টানাপড়েন, জাতীয় পার্টির
জেলা আহবায়ক ও সাবেক এমপি গতবার বিএনপিতে যোগদান করে ধানের শীষ নিয়ে ভোট
করার ফলে দেখা দিয়েছে বিভক্তি।
গাইবান্ধায়
অন্য ইসলামী দলগুলোর কোনো কর্মসূচি তেমন একটা চোখে পড়ে না। তবে ভিন্ন
কৌশলে এগোচ্ছে জামায়াত। বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন ও রাজনৈতিক
কৌশলের কারণে এবার এককভাবে নির্বাচন করতে চায় দলটি। সে লক্ষ্যেই প্রস্তুতি
নিচ্ছে তারা। ইতিমধ্যে গাইবান্ধার পাঁচটি আসনের সবকয়টিতেই নিজেদের একক
প্রার্থী ঠিক করেছে জামায়াতে ইসলামী।
আসন্ন
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন যারা চান তাদের মধ্যে রয়েছেন সদর আসনের
টানা তিনবারের সংসদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ মাহাবুব আরা বেগম গিনি, জেলা
আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক ও সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক মণ্ডল,
সহ সভাপতি ফরহাদ আব্দুল্লাহ হারুন বাবলু, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক
সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ সারোয়ার কবীর, আমিনুর জামান
রিংকু, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোঃ শামসুর রহমান টুটুল ।
জেলা
আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, দীর্ঘদিনের কর্মকাণ্ডের
মূল্যায়ন করে তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তিনি এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন।
দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে ক্ষমতাসীন দল
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের প্রচার ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ
বেড়েছে। বর্তমান এমপি মাহাবুব আরা বেগম গিনি এ আসন থেকে পরপর তিনবার
নির্বাচিত হয়েছেন। পরপর দুই মেয়াদে জাতীয় সংসদে হুইপের দায়িত্ব পালন করছেন।
আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে দলে এখন পর্যন্ত অন্তত ছয়জন প্রতিদ্বন্দ্বী
রয়েছে। তারা সকলেই গণ সংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।
জাতীয়
সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষিত হওয়ার আগেই
ভোটের মাঠে নেমে গেছেন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকেই। একাধিক মনোনয়ন
প্রত্যাশীর সরব উপস্থিতিতে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতি। গোটা
এলাকাজুড়ে শোভা পাচ্ছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বাহারি পোস্টার ও ফেস্টুন।
গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে বেশ কয়েকজন নেতা প্রচারণা শুরু করায় নতুন মাত্রা
পেয়েছে বিএনপির তৃণমূলের রাজনীতি। এরমধ্যে রয়েছেন বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির
গ্রাম বিষয়ক সম্পাদক আনিসুজ্জামান খান বাবু, দলের জেলা সাধারণ সম্পাদক
মাহামুদুন নবী টিটুল, ঢাকাস্থ গাইবান্ধা জাতীয়তাবাদী ফোরামের সদস্য সচিব
মাজেদ হাসান লিটন, সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আউয়াল আরজু, সদর
উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস
চেয়ারম্যান মোর্শেদ হাবীব সোহেল এবং জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক
অ্যাডভোকেট মঞ্জুর মোর্শেদ বাবুসহ আরও অনেকে।
জেলা
বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুন নবী টিটুল বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের
চেয়ে গাইবান্ধায় বিএনপি অনেক বেশি সংগঠিত। পার্টিতে কোনো বিভেদ-কোন্দল নেই।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলের পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। নির্বাচনে
কম সময়ের নোটিশে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে সব আসনেই সম্ভাব্য দলীয়
প্রার্থী ঠিক করে রাখার প্রক্রিয়া চলছে।
'বিএনপির
মাজেদ হাসান লিটন বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের অধিনে নির্বাচনে যাবো
না, আমরা এই ফ্যাসিষ্ট সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার
প্রতিষ্ঠার আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ নির্বাচনের কথা এখন ভাবছিনা। আমি নিজে
গ্রামেগঞ্জে গিয়ে বিএনপির তৃনমূল পর্যায়ের নেতাকর্মী ও জনগনের সাথে কথা
বলছি, আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। '
এ
ছাড়া শান্ত রাজনীতির মাঠে এখন ঘর গোছাতে মাঠে নেমেছে আরেক বড় রাজনৈতিক দল
জাতীয় পার্টি (জাপা)। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সহযোগী
সংগঠনগুলোকে শক্ত ভিত দিতে তৎপর দলটি। দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত
নেতাদের হাতে আগামী দিনের হাল তুলে দিতে চায় জাপা। এমনটি জানিয়েছেন দলটির
জেলা নেতারা।
একাদশ জাতীয়
সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা জাতীয় পার্টির সভাপতি আবদুর রশীদ সরকার দলত্যাগ
করে বিএনপির প্রার্থী হওয়া এবং পরাজিত হয়ে আবার পার্টিতে ফিরে আসার বিষয়টি
ভোটের মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন জাপার তৃণমূলের
নেতাকর্মীরা। জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতৃত্ব নিয়েও চলছে টানাপেড়ন। এতে
সামগ্রিকভাবে দল দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
দ্বাদশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-২ (সদর) আসনে দলের মনোনয়ন পেতে জেলা
কমিটির সদস্য সচিব সারোয়ার হোসেন শাহীন বেশী আলোচনায় রয়েছেন। তিনি জাতীয়
ছাত্রসমাজের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন, এরপর জেলা যুবসংহতির সভাপতিও
ছিলেন। জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
এছাড়াও জেলা আহ্বায়ক আবদুর রশীদ সরকারও মনোনয়ন চাইবেন। তিনিও মাঠে গিয়ে
জাতীয় পার্টির পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। আবদুর রশীদ সরকার তিনবার গাইবান্ধা
পৌরসভার কমিশনার এবং দুবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
জাতীয়
পার্টি গাইবান্ধা জেলা কমিটির সদস্য সচিব মোঃ সরওয়ার হোসেন শাহীন বলেন,
জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভক্তি নেই। পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও
চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বে দলটি এখন ঐক্যবদ্ধ। এ আসনে আমাকে মনোনয়ন
দিলে সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে এবং আমি৷ বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ
সদস্য নির্বাচিত হতে পারবো।
অন্যদিকে
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন
কৌশলে এগোচ্ছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ
১০ দফা দাবি এবং জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে শক্তি দেখাতে
চাইছে। একই সঙ্গে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি রয়েছে। ইতিমধ্যে গাইবান্ধার সবকটি
আসনে তারা প্রার্থীও ঠিক করেছে। তবে আপাতত দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক
আন্দোলনেই থাকতে চায়। এ জন্য তারা নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবে। এমনটাই
জানিয়েছেন দলটির জেলা নেতারা।
গাইবান্ধা-২
(সদর) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে দলটির
গাইবান্ধা জেলা শাখার আমির ও কেন্দ্রীয় সুরা সদস্য মো. আবদুল করিম সরকারের
নাম শোনা যাচ্ছে। ২০১৪ সালের মার্চে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে গাইবান্ধা
সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
জামায়াতে
ইসলামী গাইবান্ধা জেলা আমীর মোঃ আব্দুল করিম বলেন, এই আসনে আমাদের বড় ভোট
ব্যাংক রয়েছে। এর আগেও আমি এখানে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। ভোট
সুষ্ঠু নিরপেক্ষ হলে এ আসনটিতে আমাদের বিজয় হবে।
গাইবান্ধায়
বেশকটি বাম রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকলেও, এরমধ্যে গোটা পাঁচেক দল
সক্রিয়। বাকিরা প্রায় নামসর্বস্ব। দলগুলো বিভিন্ন ইস্যুতে যুগপৎ কর্মসূচি
পালন করলেও মত ও পথের কথা বলে বহুধাবিভক্ত। নির্বাচন করার চেয়ে বিভিন্ন
ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা
রাখার দিকেই তাদের নজর বেশি।